ঢাকারবিবার , ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩
  • অন্যান্য
আজকের সর্বশেষ সবখবর

এক কালেমায় রুটি রুজি আর এক কালেমায় ফাঁসি’; এটা গান নয় বরং ইতিহাসের স্বরণীয় অংশ

আজাদীর কন্ঠ ধর্মীয় প্রতিবেদন
ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০২৩ ৩:৩৪ অপরাহ্ণ । ১০৭৭ জন
বর্তমানে সর্বমহলে আলোচিত বাক্য "এক কালেমায় রুটি রুজি আর এক কালেমায় ফাঁসি" এটি কোন গান নয় বরং ইতিহাসের সর্ববৃহৎ স্বরণীয় একটি অংশ

হাফেজ মাওঃ মুফতী সাইফ উদ্দীন আল-আজাদ: লেখক ও গবেষক|

কালিমার সঠিক ব্যাখ্যা ও দাওয়াত দেওয়ার কারণে “তাফসীর ফি যিলালিল কুরআন” এর রচয়িতা মিশরের সাঈয়্যেদ কুতুব রহিমাহুল্লাহকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল।ইসলামি আন্দোলনের প্রাণপুরুষ সাঈয়্যেদ কুতুব রহিমাহুল্লাহকে যেদিন ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হলো, সেদিন মিশরের পথে পথে তার রচিত তাফসীর “ফি যিলালিল কুরআন”এর সাত অথবা আট হাজার সেট অর্থাৎ চৌষট্টি হাজার পুস্তক পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল।তাগুত-সরকার রাষ্ট্রীয়ভাবে ঘোষণা করেছিল, যে ব্যক্তির কাছেই সাইয়্যেদ কুতবের এর বই পাবে, তাকেই দশ বছর জেলে পুরে রাখা হবে। নিষ্প্রাণ দেহে সাঈয়্যেদ কুতুবের বইগুলো প্রাণের সঞ্চার করতো। যার কারণে যে-ই কুতুবের কিতাব পাঠ করে, সে-ই তার অনুসারী ও অনুরক্ত হয়ে পড়ে।এই মহান মণীষীর শাহাদাতের ঘটনা দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়লে সবার মনের কোণে একটি প্রশ্ন উঁকি দিলো; কে এ সাঈয়েদ কুতুব? কী তার পরিচয়? তাকে ফাঁসি দিয়ে হত্যা-ই বা করা হলো কী জন্যে? মানুষজন তাকে জানতে শুরু করলো। তার দর্শনের সাথে পরিচিত হওয়া শুরু করলো। পরিচিত হওয়া শুরু করলে তার বিপুল চিন্তা-সাহিত্য কর্মের সাথে।তাকে ফাঁসি দেওয়ার পর তার তাফসীরের কদর এই পরিমাণ বেড়েছে যে, বৈরুতের খ্রিস্টান প্রকাশকেরা প্রকাশনা জগতে কোনো ধরনের লোকসান খেলে তাকে বলতো তুমি যদি বাঁচতে চাও তাহলে সাইয়্যেদ কুতুবের ‘ফি যিলালিল’ কুরআন’ ছাপো। এমনকি যে বছর সাইয়্যেদ কুতুবকে শহীদ করা হয়েছিল, সে বছরই তার রচিত তাফসীর “ফি যিলালিল কুরআন”-এর সাতটি সংস্করণ ছাপা হয়েছে। কিন্তু এই গ্রন্থটি তিনি বেঁচে থাকাবস্থায় শুধু একবার ছাপা হয়েছিল।তাকে ফাঁসি দেওয়ার পর তার তাফসীরের কদর এই পরিমাণ বেড়েছে যে, বৈরুতের খ্রিস্টান প্রকাশকেরা প্রকাশনা জগতে কোনো ধরনের লোকসান খেলে তাকে বলতো তুমি যদি বাঁচতে চাও তাহলে সাইয়্যেদ কুতুবের ‘ফি যিলালিল’ কুরআন’ ছাপো। এমনকি যে বছর সাইয়্যেদ কুতুবকে শহীদ করা হয়েছিল, সে বছরই তার রচিত তাফসীর “ফি যিলালিল কুরআন”-এর সাতটি সংস্করণ ছাপা হয়েছে। কিন্তু এই গ্রন্থটি তিনি বেঁচে থাকাবস্থায় শুধু একবার ছাপা হয়েছিল।এখন তো অবস্থা এমন যে, পৃথিবীর এমন কোনো প্রান্ত পাওয়া যাবে না যেখানে সাঈয়্যেদের এই তাফসীরগ্রন্থ গিয়ে পৌঁছেনি। এমন কোনো ভাষাও পাওয়া যাবে না, যে ভাষায় তা অনূদিত হয়নি। (তাফসীরে সূরা তাওবা আব্দুল্লাহ আযযাম, পৃষ্ঠা ২৮৪) সাঈয়্যেদকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করার পূর্বরাতে তাকে কালিমা পড়াবার জন্যে জেলে চাকরিরত ইমাম সাহেবকে পাঠানো হলো ইমাম সাহেবকে দেখে সাঈয়্যেদ কুতুব (রহঃ) জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কী জন্য এখানে এসেছেন”? ইমাম সাহেব বললেন, আমি আপনাকে কালিমা পড়ানোর জন্যে এসেছি। আসামিদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আগে কালিমা পড়ানোটা আমার দায়িত্ব।সাঈয়্যেদ কুতুব বললেন, এই দায়িত্ব আপনাকে কে দিয়েছে? ইমাম সাহেব বললেন সরকার দিয়েছে। তিনি পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন এটার বিনিময়ে কি আপনি বেতন পান? ইমাম সাহেব বললেন, হ্যাঁ, আমি সরকার থেকে বেতন পাই।তখন সাঈয়্যেদ কুতুব রহিমাহুল্লাহ বললেন, কী আশ্চর্য! যে কালিমা পড়ানোর কারণে আপনি বেতন-ভাতা পান, সে একই কালিমার ব্যাখ্যা লিখে মুসলিম উম্মমাহকে জানানোর অপরাধেই তো আমাকে ফাঁসি দেওয়া হচ্ছে!আফসোস, “তোমার কালিমা তোমার রুটি-রুজি যোগায়, আর আমার কালিমা আমাকে ফাঁসিতে ঝুলায়!

কে এই সাঈয়্যেদ কুতুব?

সাঈয়্যেদ কুতুবের মূল নাম হলো সাঈয়্যেদ; কুতুব হলো তার বংশীয় উপাধি। তার পূর্বপুরুষরা আরব উপদ্বীপ থেকে এসে মিসরের উত্তরাঞ্চলে বসবাস শুরু করেন। পিতার নাম হাজী ইবরাহিম কুতুব। তিনি ছিলেন চাষি। করতেন চাষাবাদ করতেন। মাতার নাম ফাতিমা হোসাইন উসমান, যিনি ছিলেন অত্যন্ত ধার্মিক মহিলা। তারা মোট দুই ভাই এবং তিন বোন ছিলেন। ভাইরা হলেন সাঈয়্যেদ কুতুব এবং মুহাম্মাদ কুতুব। আর বোনেরা হলেন হামিদা কুতুব এবং আমিনা কুতুব। পঞ্চম বোনের নাম জানা যায়নি। সাঈয়্যেদ ছিলেন সবার বড়ো। তাঁরা সব ভাই-বোনই উচ্চশিক্ষা লাভ করেন এবং ইসলামী আন্দোলনের জন্য অনেক বেশি ত্যাগ স্বীকার করেন।সাঈয়্যেদ কুতুব ১৯০৬ সালে মিসরের উসইউত জেলার মুশা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।নিজ গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সাঈয়্যেদ কুতুবের শিক্ষা শুরু হয়। মায়ের ইচ্ছানুসারে তিনি শৈশবেই কুরআন হিফজ করেন। পরবর্তীকালে তার পিতা কায়রো শহরের উপকণ্ঠে হালওয়ান নামক স্থানে বসবাস শুরু করেন। তিনি তাজহিযিয়াতু দারুল উলুম মাদরাসায় শিক্ষা সমাপ্ত করে কায়রোর বিখ্যাত মাদরাসা দারুল উলুমে ভর্তি হন। ১৯৩৩ সালে ওই মাদরাসা থেকে বিএ ডিগ্রি লাভ করেন এবং সেখানেই অধ্যাপক নিযুক্ত হন।কিছুকাল অধ্যাপনা করার পর তিনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে স্কুল ইন্সপেক্টর নিযুক্ত হন। মিসরে ওই পদটিকে অত্যন্ত সম্মানজনক বিবেচনা করা হয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকেই তাকে আধুনিক শিক্ষাপদ্ধতি পড়াশোনার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়।তিনি দু’বছরের কোর্স শেষ করে বিদেশ থেকে দেশে ফিরে আসেন। আমেরিকায় থাকাকালেই তিনি বস্তুবাদী সমাজের দুরবস্থা লক্ষ্য করেন। তার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে যে, একমাত্র ইসলামই সত্যিকার অর্থে মানবসমাজকে কল্যাণের পথে নিয়ে যেতে পারে।আমেরিকা থেকে দেশে ফেরার পরই তিনি ইখওয়ানুল মুসলেমিন দলের আদর্শ, উদ্দেশ্য ও কর্মসূচি যাচাই করতে শুরু করেন। ১৯৪৫ সালে তিনি ওই দলের সদস্য হয়ে যান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সরকার যুদ্ধ শেষে মিসরকে স্বাধীনতাদানের ওয়াদা করেন। যুদ্ধ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ইখওয়ান দল ব্রিটিশের মিসর ত্যাগের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। এর ফলে তাদের জনপ্রিয়তা অত্যন্ত বেড়ে যায়। মাত্র দু’বছর সময়ের মধ্যে এ দলের সক্রিয় কর্মীসংখ্যা পঁচিশ লাখে পৌঁছে। সাধারণ সদস্য, সমর্থক ও সহানুভূতিশীলদের সংখ্যা ছিল কর্মী সংখ্যার কয়েকগুণ বেশি। ব্রিটিশ ও স্বৈরাচারী মিসর সরকার ইখওয়ানের জনপ্রিয়তা দেখে ভীত হয়ে পড়ে এবং এ দলের বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়।১৯৫২ সালের জুলাই মাসে মিসরে সামরিক বিপ্লব সংঘটিত হয়। ওই বছরই ইখওয়ান দল পুনরায় বহাল হয়ে যায়। ড, হাসানুল হোদাইবি দলের মোরশেদু-এ-আম নির্বাচিত হন। দলের আদর্শ প্রচার ও আন্দোলনের সম্প্রসারণ বিভাগ তার পরিচালনাধীনে অগ্রসর হতে থাকে। পরিপূর্ণরূপে নিজেকে আন্দোলনের কাজে উত্সর্গ করেন তিনি।১৯৫৪ সালে ইখওয়ান পরিচালিত সাময়িকী-‘ইখওয়ানুল মুসলিমিন’-এর সম্পাদক নির্বাচিত হন। ছ’মাস পরই কর্নেল নাসেরের সরকার পত্রিকাটি বন্ধ করে দেয়। কারণ, ওই বছর মিসর সরকার ব্রিটিশের সঙ্গে নতুন করে যে চুক্তিপত্র সম্পাদন করে, পত্রিকাটি তার সমালোচনা করে। পত্রিকা বন্ধ করে দেয়ার পর নাসের সরকার এ দলের ওপর নির্যাতন শুরু করে। একটি বানোয়াট হত্যা ষড়যন্ত্র মামলার অভিযোগে ইখওয়ানুল মুসলিমিন দলকে বেআইনি ঘোষণা করে দলের নেতাদের গ্রেফতার করা হয়। এরপর তো অনেক নেতাকে হত্যা করা হয়। যাদের মধ্যে সাঈয়্যেদও একজন।

error: Content is protected !!